মানিকগঞ্জের মানিক ; সাইদুর রহমান বয়তী
সম্পাদকীয়ঃ
বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলে সমতলভূমিতে অবস্থিত শান্তিপূর্ণ একটি জেলা মানিকগঞ্জ। এ জেলায় জন্ম নিয়েছেন বহু গুণীজন। মানিকগঞ্জের মানুষ হিসেবে আমাদের উচিত তাদের সম্পর্কে জানা। আসুন আমরা এসব কৃতি ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু জানার চেষ্টা করি।
তথ্যে কোন প্রকার ভুল থাকলে কমেন্টে সেটি উল্লেখ করবেন আশা করি।
~: সাইদুর রহমান বয়াতি : ~
লোকসঙ্গীতের সাধক গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী সাইদুর রহমান বয়াতি। তিনি মানিকগঞ্জের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। সাইদুর রহমান বয়াতি বাংলা ১৩৩৮ সনের জৈষ্ঠ মাসে মানিকগঞ্জের পুটাইল ইউনিয়নের হাসলি গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার বাবা জিগির আলী ছিলেন গান পাগল মানুষ। বাবার সাথে ছোটবেলা থেকেই দোতরা বাজিয়ে গান গাইতেন। আর এভাবেই তার নামের সাথে বয়াতি শব্দটি জুড়ে যায়।
১৪ বছর বয়সে স্থানীয় শিক্ষক ইয়াসিন মাস্টার তাকে জোর করে পশ্চিম হাসলি ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করেন। ৫ম শ্রেণীতে পড়ার সময় পায়ে হেঁটে ১৯৫১ সনে জিন্নাহ সাহেবকে দেখতে ঢাকায় গিয়েছিলেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে জিন্নাহকে একটি স্মারকলিপি দিয়েছিলেন। এসময় তিনি একটি কবিতা লিখেছিলেন ‘‘আমার ভাষায় বলব কথা। তোদের কেন মাথা ব্যথা এই ভাষাতে জুড়ায় প্রাণ, তোদের কি তাতে যায়রে মান’’ এটাকে পরে গানের সুর দেন। এটি ছিল তার প্রথম লেখা গান। সেই থেকে গান লেখা ও নিজের গানে সুর দেওয়ায় তার অবিরাম যাত্রা।
১৯৭১ সালে সাইদুর রহমান বয়াতি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। সহযোদ্ধাদের সাহস দেয়ার জন্য তিনি বিভিন্ন গান ও কবিতা লিখতেন। ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে দেওয়া এক সংবর্ধনায় সাইদুর রহমান বয়াতি শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে নিজের লেখা একটি গান গেয়ে শোনান। এতে শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত খুশি হয়ে তাকে একটি ঘড়ি উপহার দেন।
সাইদুর রহমান বয়াতি বিয়ে করেন ঘোস্তা গ্রামের জমশের আলীর মেয়ে সালেহা বেগমকে। এই ঘরে আলো করে জন্ম নিয়েছে ৩ ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে আবুল বাশার আব্বাসীও বাবার মতো সংগীত ভুবনে আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
সাইদুর রহমান বয়াতি কিশোর বয়স থেকে 'বাসুদেব অপেরা' দলে যাত্রাপালায় অভিনয় করেছেন। তিনি লম্বা চুল রেখে নারী চরিত্রে অভিনয় করেন। সেসময়ের বিখ্যাত নায়িকা 'রানী' আজকের সাইদুর রহমান বয়াতি।
মেট্রিক পরীক্ষায় গণিতে ফেল করার পর তিনি লেখাপড়ায় ইস্তফা দেন। এরপর তিনি নৌবাহিনীতে চাকুরি নেন। কিছুদিনপর এ চাকুরি ইস্তফা দিয়ে তিনি মানিকগঞ্জে কো-অপারেটিভ ব্যাংকে চাকুরি গ্রহণ করেন। কিন্তু ব্যাংকের হিসাবের খাতায় গান লেখার 'অপরাধে' তার চাকুরি চলে যায়। এরপর তিনি একটি মুদি দোকান চালু করেন ও গানে আত্মনিয়োগ করেন।
লোকসংগীত সাধানার পাশাপাশি তিনি লোক সংস্কৃতির নানা বিষয় সংগ্রহ, লোকসংস্কৃতি, লোক সঙ্গীত, বাংলাদেশের লোক সঙ্গীতের আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কিত বিভিন্ন সেমিনার, রেডিও টিভি'র টকশো সেমিনারেও আলোচক হিসেবে অংশ নিচ্ছেন। আধ্যাত্ম সাধনার পাশাপাশি পড়ছেনও প্রচুর। বর্তমানে তিনি লোকসঙ্গীতে বাংলা একাডেমীর ফেলোশিপও পেয়েছেন।
সাইদুর রহমান বয়াতি চলচ্চিত্রে গান করার পাশাপাশি অভিনয়ও করেছেন। তার অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে নদীর নাম মধুমতি, লাল সালু, চিত্রানদীর পাড়ে, লালন, লিলি পুটেরা বড় হও ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। নদীর নাম মধুমতি চলচ্চিত্রে গানের জন্য তিনি 'জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার' লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পদক।
সায়েদুর রহমান বয়াতী তার এই দীর্ঘ জীবনে দেশ এবং সংগীতকে দিয়েছেন অনেক, কিন্তু বিনিমযয়ে পাননি কিছুই, চানও না। অব্যাহত আর্থিক অনটনকে পরাভূত করে চলছে তার সংগীত চর্চা, চলবে আমৃত্যু।

No comments