ইতালি বনাম স্পেনঃ বদলে যাওয়া ইতালি নাকি পূর্ণজাগরিত স্পেন?





ইতালি বনাম স্পেনঃ বদলে যাওয়া ইতালি নাকি পূর্ণজাগরিত স্পেন?

   লেখক 

কবির এম হোসেন 


ইতালি নাকি স্পেন? বিলম্বিত ইউরোতে কয়েক দিন আগেও এই প্রশ্ন খুব বেশি ঘুরপাক খায়নি । ফেবারিটের তাকমা ছিল না দুই দলের কোন দলের গায়েই। কিন্তু সব হিসাব নিকাষ উলট-পালট করে দিয়ে নীল আর লাল সৈন্যরা ইউরোপের বাঘা বাঘা বাহীনিকে ঝেটে বিদায় করে দিয়ে সেমিফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে। 


উচ্চাভিলাষী রবার্তো মানচিনি ইতালির প্রধান প্রশিক্ষকের দায়িত্ব নেওয়ার পর ইতালিকে তার খোলস থেকে বের করে নিয়ে এসেছেন। ইতালি টানা ৩২ ম্যাচ অপরাজিত, জয়ী টানা ১৫ ম্যাচে। পুরো ইউরোতে হজম করেছে মাত্র দুই গোল, প্রতিপক্ষকে উপহার দিয়েছে ১১ গোল। ইতালির খেলার ধরন দেখে অনেকেই দ্বিধান্বিত ছিলেন এটা কি সত্যি ইতালিয়ান ফুটবল দল নাকি নীল জার্সি পরিহিত অন্য কোন দল?


সোনালী পজন্ম স্পেনের জন্য অতীত । নিজেদের সেরা সাফল্য পিছনে ফেলে স্পেন সমর্থকেরা এখন প্রতিটি আসর শুরু করেন গ্রুপ পর্ব কিংবা নকআউট থেকে বিদায়ের ভয় নিয়ে। কিন্তু ক্লাব পর্যায়ের সফল কোচ লুইস এনরিকে স্পেনের প্রধান প্রশিক্ষকের দায়িত্ব নেওয়ার পর স্প্যানিশরা নতুন করে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে।  তাদের সেই স্বপ্ন পুরণে কতটুকু উজাড় করে দিতে পারবে লুইস এনরিকের সদস্যরা তা আজই টের পাওয়া যাবে।


আজ বাংলাদেশ সময় রাত ১টায় লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ইউরা-২০২০ এর প্রথম সেমিফাইনালে মুখোমুখি হচ্ছে ইতালি ও স্পেন।


মুখোমুখি পরিসংখ্যানঃ


আজকের সেমিফাইনাল দুই দলের  জন্যই প্রতিশোধের। সর্বশেষ তিনটি ইউরোতেই মুখোমুখি হয়েছে স্পেন ও ইতালি। তাতে অবশ্য এগিয়ে স্পেন। ২০০৮ ইউরো  যে আসরের মাধ্যমেই ইউরোপ ও বিশ্বে স্পেন রাজত্ব শুরু হয়েছিলো, সেই আসরে কোয়ার্টার ফাইনালে মোকাবেলা  করেছিলো ইতালি ও স্পেন। নির্ধারিত সময়ে গোল শুণ্য থাকার পর পেনাল্টি শুট আউটে ইকার ক্যাসিয়াসের কাছে নতি স্বীকার করেছিলো আজুরিরা। পরের বার দেখাতেও ইতালির হার। এবার হার সব থেকে আলাদা কারন ইউরো-২০১২তে ইতালিকে পরাজিত করে শিরোপার হ্যাট্রিক করেছিলো স্পেন। 


স্পেনের অবশ্য সেখানেই শেষ। সেই আসরের মাধ্যমেই স্পেনের ক্ষয়ে যাওয়া শুরু হয়। ২০১৬ ইউরোতে দ্বিতীয় রাউন্ডেই দেখা হয় ইতালি স্পেনের । এ যাত্রায় জয় পায় ইতালি। ইতালি চাইবে ২০১২ ইউরো ফাইনালে পরাজিত হয়ে শিরোপা হাত ছাড়া হওয়ার প্রতিশোধ নিতে আর স্পেন  চাইবে ইউরো-২০১৬ সালের দ্বিতীয় রাউন্ডে বিদায় হওয়ার প্রতিশোধ নিতে। তবে দুই দলের মুখোমুখি লড়াই এগিয়ে আছে স্পেন। মোট ৩৩ বার মুখোমুখি লড়াইয়ে ইতালি জয়ী ৯ বার, ড্র ১২ বার আর স্পেন জয়ী ১২ বার। 


অপ্রতিরোধ্য ইতালি


তুরস্ককের সাথে ৩ গোলে জয়ের মাধ্যমে ইতালির ইউরো-২০২০ যাত্রা হয়। পরের ম্যাচেও সুইৎজারল্যান্ডকে ৩ তিন গোলে পরাজিত করে জর্জিনহো, বনুচ্চিরা। টানা দুই ম্যাচ জয়ের মাধ্যমে দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত করে আজুরিরা। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে ওয়েলসের বিপক্ষে দ্বিতীয় সারির দল নামিয়েও ১ গোলের জয় তুলে নেয় রবার্তো মানচিনির শিষ্যরা। টানা ১৯ ঘন্টা ২৮ মিনিট গোল হজম না করার নজির অব্যাহত রাখে ইতালি।


গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে যায় ইতালি। প্রতিপক্ষ হিসেবে পায় ডেভিড আলাবার অস্ট্রিয়াকে। অস্ট্রিয়া পরীক্ষা নেয় ইতালির। নির্ধারিত সময়ের খেলা গোল শূণ্য ড্র হলে ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ে করা দুই গোলে জয় পায় ইতালি। এ ম্যাচেই ইতালিয়ান নজির ১৯ ঘন্টা ২৮ মিনিট পর গোল হজম করে জিয়ানলুইজি ডোনারামারা। 


প্রতিপক্ষ দুর্বল এজন্যই ইতালি এত জয় পাচ্ছে, এত গোল পাচ্ছে; এই অপবাদের কড়া জবাব দেয় তারা কোয়ার্টার ফাইনালে। ফিফা র‌্যাংকিংয়ে থাকা ১ নম্বরের দল, আসরের হট ফেবারিট বেলজিয়ামকে তারা হতাশা উপহার দিয়ে আসর থেকে বিদায় করে দেয়। লোকাতেল্লি, ইনিসিনিয়েদের সামনে কুলিয়ে উঠতে পরেন নি কেভিন ডি ব্রনি, রোমেলু লুকাকুরা। নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে আর আস্ত্রে শান দিয়ে লন্ডনের টিকিট পান মানচিনি বাহিনি।


জেগে উঠা স্পেন


বিগত তিন ইউরো আসরের দু্টিই জিতেছে স্পেন। কিন্তু ২০১২ আসরের পর তাদের স্বপ্ন যাত্রার সমাপ্তি ঘটে। টানা তিনটি মেজর শিরোপা জয়ের পর স্পেনের ফুটবল শক্তি দিনে দিনে ধ্বস নামে। যার ফল হিসেবে ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপ থেকে গ্রুপ পর্বে বাদ, ২০১৬ সালের ইউরো আর ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ডের বাধাই টপকাতে পারেনি স্পানিশরা। হুলিয়ান লোপেতিগি স্পেন জাতীয় দলের প্রধান প্রশিক্ষকের দায়িত্ব নেওয়ার পর ঘুরে দাড়াতে শুরু করেছিল তারা কিন্তু রাশিয়া বিশ্বকাপ শুরুর প্রাক্কালে সব এলোমেলো হয়ে যায় তাদের।


স্পেন ফুটবল ফেডারেশন যেদিন সাবেক বার্সেলোনা প্রশিক্ষক লুইস এনরিকে’কে স্পেন জাতীয় দলের প্রধান প্রশিক্ষক ঘোষণা করেন সেদিন অনেইকেই চমকে গিয়েছিলো।কাতালুলিয়ান লুইসকে অনেকেই স্পেন জাতীয় দলের প্রধান প্রশিক্ষক হিসেবে সুনজরে দেখেননি। 


স্পেন প্রধান প্রশিক্ষক হিসেবে লুইস এনরিকের এটা দ্বিতীয় আমল । কন্যা জানা মার্টিনেজ ক্যান্সরে আক্রান্ত হওয়ায় একবার স্বেচ্ছায় প্রধান প্রশিক্ষক পদটি ছেড়ে দেন এনরিকে। ফুটবল থেকে দূরে সরে যেতে হয়েছিলো এনরিকে’কে। ক্যান্সরে আক্রান্ত কন্যাকে বাঁচাতে পারেননি তিনি। স্পেন ফুটবল ফেডারেশন আবার তাকে ডেকে আনেন, তার উপর আবার তুলে দেন স্প্যানিশ গৌরব ফিরিয়ে আনার গুরুত্বর্পর্ণ দায়িত্ব।


ইউরোটা মোটেও দাপুটে শুরু হয়নি স্প্যানিশদের।গ্রুপ-ই এর প্রথম ম্যাচে ভিক্টর লিন্ডেলফের সুইডেনের সাথে গোল শুণ্য ড্র, পরের ম্যাচে রাবার্ট লেভান্ডভস্কির পোল্যান্ডের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে স্পেন। প্রথম দুই ম্যাচের ফলাফল দেখে অনেকে ধরে নিয়েছিলো আরো একবার হতশা উপহার দিয়ে বড় আসরে মুখ থুবরে পড়বে স্পেন।কিন্তু গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে স্লোভাকিয়ার জালে ৫ বার বল জড়িয়ে নতুন করে শুরু করে ফেরান তোরেস, আলভারো মোরাতারা। 


দ্বিতীয় রাউন্ড ও কোয়ার্টার ফাইনালের কোন ম্যাচেই তারা নির্ধারিত সময়ে জিততে পারে নি। দ্বিতীয় রাউন্ডে লুকা মড্রিচের ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে তারা উপহার দেয় চলতি ইউরোর অন্যতম সেরা ম্যাচ। ৩-৩ গোলে অমিমাংসিত থাকার পর অতিরিক্ত সময়ে ৫-২ গোলের জয় তুলে বিশ্বকাপ রানার্স-আপ ক্রোয়েশিয়াকে বিদায় করে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে স্পেন।


কোয়ার্টার ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ ছিলো সুইৎজাল্যান্ড।আরো বেশি নাটুকে হয় স্পেন বনাম সুইৎজাল্যান্ড ম্যাচ। নির্ধারিত সময়ে ও অতিরিক্ত সময়েও অমিমাংসিত থাকলে পেনাল্টি শুট আউটে ভাগ্যের জোড়ে জয় তুলে নেয় স্পেন। 


ইতালির ফর্মেশন ও কৌশল


ইতালি মানেই রক্ষণ, শক্তিশালী প্রতিরোধ। ম্যাচের পুরোটা সময় নিজ গোল বার অক্ষত রেখে দুই একবার প্রতি আক্রমণের সুযোগ পেলে দৌড়ে গিয়ে একটা গোল  দিয়ে আবার প্রতিরোধ। এটা ছিল ইতালিয়ান ফুটবলের মূলমন্ত্র।এই মন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে একেবারে ব্যর্থও নয় তারা। মাঝে মাঝে ফুটবল বিশ্বকে চমকে দিয়ে ঘরে ফিরেছে শিরোপা নিয়ে। বিশ্ব পেয়েছে পাওলো মালদিনি, ফাবিও ক্যানভারো,লিওনার্দো বনুচ্চি, জর্জি্ও কিয়েলিনির মত জগৎ সেরা ডিফেন্ডারদের। 


এই ইতালি নতুন ইতালি। রবার্তো মানচিনি ইতালির দায়িত্ব নেওয়ার পর আমূল পরিবর্তন হয়েছে আজুরিদের। ইতালি সমর্থকেরাতো বটেই ফুটবল ভক্তরাও বদলে যাওয়া ইতালি দেখে বিষ্মিত। 


ইউরোর গ্রুপ পর্বে তারা দিয়েছে ৭ গোল, নক আউট পর্বের দুই ম্যাচে তারা দিয়েছে ৪ গোল। বিনিময়ে তারা হজম করেছে মাত্র ২ গোল। তাদের দলে ফ্রাঞ্চ, বেলজিয়াম কিংবা ইংল্যান্ড দলের মত নামিদামি স্ট্রাইকার নেই তবে লোকাতেল্লি, ইনসিনিয়ে, ইমমোবেলেরাই প্রতিপক্ষের রক্ষণকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে। ইতালিয়ান মধ্যমাঠ ও আক্রমণ ভাগের খেলোয়াড়দের মুহূর্মুহূ আক্রমণ দেখে আনেকেই সন্দিহান হয়ে পরছে দলটি কি আসলেই ইতালি?


সেমিফাইনালেও রাবার্তো মানচিনি এই ইতালিকেই চাইবে যারা নিজ গোলবার অক্ষত রেখে প্রতিপক্ষকে ঘাম ঝড়িয়ে দিবে। আদায় করে নিবে গোল, দলকে করবে জয়ী।


স্পেনের ফর্মেশন ও কৌশল


স্পেন প্রশিক্ষক লুইস এনরিকে সাহসী, কৌশলি ও একগুয়ে। ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার কোচ থাকাকালীন তিনি তার যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। তবে তার একাদশ নির্বাচন ও খেলোয়াড় নির্বাচনের ঝামেলা পুরানো। চলতি ইউরোতে স্পেনের সবচেয়ে সফল ক্লাব রিয়াল মাদি্রদের কোন খোলায়াড় অর্ন্তভুক্ত করেননি, এটা নিয়েও অবশ্য তাকে সমালোচনা শুনতে হয়েছ। তবে তার অবস্থানে তিনিই সঠিক এটা অবশ্য তিনি ক্লাবের হয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। এখন সুযোগ এসেছে জাতীয় দলের হয়ে তা দেখিয়ে দেওয়ার। 


রক্ষণ ও মধ্যমাঠ নিয়ে এনরিককে খুব একটা ভাবতে হচ্ছে না। একরিকের ভাবনা আক্রমণ নিয়ে। 


ডেভিড ভিয়া ও ফার্নান্দো তোরেস অবসর নেওয়ার পর স্পেন আর তাদের মাপের স্ট্রাইকার পায় নি। ডিয়াগো কস্তা কিছুদিন দলে থাকলেও স্পেনের জার্সি গায়ে তিনি মোটেও সফল না। ক্লাব ও দল মিলিয়ে কস্তা এখন কোথায় আছে তা হয়ত স্পেন সমর্থকেরাও জানেন না।


আলভারো মোরাতা ক্লাব পর্যায়ে সাফল্যের আশায় বছরে বছরে ক্লাব বদলাচ্ছেন। অবশেষে ইভেন্তাসে খেলছেন, তবুও ধারে। চলতি ইউরোতো সুইৎজারল্যান্ডের বিপক্ষে পেনাল্টি মিস করে আরো বেশি সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন। তবে কোচ এনরিকের আস্থা আছে তার উপর। 


পাবলো সারাবিয়া আহত থাকায় তার খেলা নিয়ে আশংকা রয়েছে। তাই স্পেন আক্রমণের মূল দায়িত্ব থাকবে মোরাতা ও ফেরান তোরেসের কাধেঁ।


সম্ভাব্য একাদশঃ


ইতালিঃ ডোনারামা, বনুচ্চি, কিয়েলিনি ,লোরেন্জা, এমারসন ,বেরেলা, জর্জিনহো, ভেরাত্তি, ইনিসিনিয়ে, কিয়েজা, ইমমোবেলে।


স্পেনঃ  সিমন,আলাবা, আজুকুলিপিইতা, লাপোর্ত, পাও তোরেস, কোকে, বুসকেটস, পেড্রি,  ওলমো, ফেরান তোরেস, মোরাতা।

No comments

Auto Scroll Stop Scroll