বাতিস্ততা থেকে পেপ গার্দিওলা; জাভি থেকে স্নাইডারঃ কাতার স্টার লীগের হাই প্রোফাইল ফুটবলাররা

 






বাতিস্ততা থেকে পেপ গার্দিওলা; জাভি থেকে স্নাইডারঃ কাতার স্টার লীগের হাই প্রোফাইল ফুটবলাররা


আধুনিক ফুটবলে বিস্ময়ের নাম কাতার। পারস্য সাগরের বুকে ছোট্ট দেশ কাতার ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হয়ে সমগ্র ফুটবল বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। টাকার ঝনঝনানিতে আজকাল তারা বিশ্বে নতুন নতুন বিষ্ময় সৃষ্টি করছে। ইউরোপ থেকে অনেক নামী দামী ফুটবলার ক্যারিয়ারের সয়াহ্নে কাতারি ক্লাবগুলোকে বেছে নিচ্ছে পেশাদর ফুটবল খেলার জন্য।



কাতারে ঘরোয়া ফুটবল শুরু হয় ১৯৬৩ সালে। কিন্তু লীগ ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয় ১৯৭৩ সালে। প্রতি মৌসুমে ১২টি দল কাতার স্টার লীগ নামের পেশাদার লীগে খেলে থাকে। মৌসুমে শেষে সর্বোচ্চ পয়েন্টধারী দল হয় চ্যাম্পিয়ন আর সর্বনিম্ন পয়েন্টধারী দলটি অবনমনের শিকার হয়ে কাতার দ্বিতীয় বিভাগে চলে যায়। কাতার দ্বিতীয় বিভাগ চ্যাম্পিয়ন দলটি আবার কাতার স্টার লীগে খেলার সুযোগ লাভ করে। আল সাদ কাতার স্টার লীগের  সবচেয়ে সফল ক্লাব । তারা সর্বোচ্চ ১৮ বার লীগ শিরোপা জিতেছে। 


কাতার স্টার লীগে ইউরোপের অনেক নামীদামী ফুটলাররা খেলেছেন।  এখনো অনেক তারকা ফুটবলার কাতারের বিভন্ন ক্লাবকে বেছে নিচ্ছেন পেশাদার ফুটবল খেলার জন্য। আজকে আমরা দেখবো কোন কোন তারকা ও সফল ফুটবলার কাতারে তাদের ফুটবল জাদু দেখিয়েছেন।


গ্যাব্রিয়েল বাতিস্ততা ( আর্জেন্টিনা) – আল আরাবি (২০০৩-০৫)


আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি গ্যাব্রিয়েল বাতিস্ততার মাধ্যমেই  কাতার স্টার লীগে তারকাদের আগমনের সূচনা হয়। বাতিস্ততা আর্জেন্টিনার হয়ে ৭৭ টি আর্ন্তজাতিক ম্যাচ খেলেন। ৫৪টি গোল করে একসময় ছিলেন আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোলদাতা, যে রেকর্ডটি লিওনেল মেসি নিজের করে নিয়েছেন। বাতিস্ততা টানা দুইটি বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয় হ্যাটট্রিক করা ফুটবলার যার গোল ‘বাতিগোল’ হিসেবে পরিচিতি পায়। 


ইতালিয়ান ক্লাব এএস রোমা থেকে ৮ মিলিয়ন ডলার দিয়ে আল আরাবি ২০০৩ সালে তাকে দলে ভেরাতে সক্ষম হয়েছিল। বাতিস্ততা অবশ্য তার মূল্য ভালো ভাবেই ফেরত দেন। প্রথম মৌসুমেই ২৫ গোল করে তার জাত চেনান ইউরোপিয়ানদের পর এশিয়ানদের। 


ইতালিয়ান ক্লাব ফিওরেন্টিনার হয়ে ক্যারিয়ারের প্রায় পুরো সময়টা কাটান বাতিস্ততা। ফিওরেন্টিনার হয়ে কিংবদন্তিও তিনি। কাতারে তিনি তার টিমমেট স্টিফেন এফেনবার্গকেও সাথে নিয়ে আসেন।ঠিক একই সময়ে কাতারি ক্লাব আল রায়ানে ছিলেন জার্মান তারকা মারিও বাসলার। 



পেপ গার্দিওলা (স্পেন) আল আহলি দোহা (২০০৩-০৫)


স্পনিশ জায়ন্ট বার্সেলোনাতে ১৭ বছর এবং ইতালিতে কয়েক মৌসুম কাটানোর পর কাতারে পারি জমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পেপ গার্দিওলা। ২০০৩ সালে যোগ দেন কাতারি ক্লাব আল আহলিতে।  কাতারে ভালোই আলো ঝলকিয়ে ছিলেন পেপ । আল আহলিকে কাতারে চ্যাম্পিয়ন বানানোর পর এই ক্লাবকে নিয়ে তিনি এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন্স লীগেও প্রতিনিধিত্ব করেন। 


কাতার স্টার লীগে আল আহলির সাম্প্রতিক ফর্ম দেখে অনেকেই বিষ্মিত হতে পারেন যে পেপ কিভাবে আল আহলিতে এসেছিলেন? আল আহলি দোহা কাতারের সেরা ক্লাবদের একটিও নয়।  সুতরাং আল আহলিতে তার যোগদান সত্যি অকল্পনীয় ছিল। এমনকি এমন কথাও শোনা যায়, ইংলিশ ক্লাব ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডে যোগ না দিয়ে পেপ আল আহলিতে যোগ দিয়েছিলেন। 


কাতারের সাথে তার এই সুম্পর্ক তিনি ধরে রাখেন। ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হিসেবে প্রতিযোগিতা করার সময় কাতার পেপ গার্দিওলাকে শুভেচ্ছা দূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলো। পেপও কাজ করেছিলেন নিষ্ঠার সাথে। কাতারকে ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক দেশের মর্যাদা আনতে পেপ রাখেন বড় ভূমিকা।



রাউল গন্জালেস ( স্পেন) আল সাদ (২০১২-১৪)


স্প্যানিশ ও রিয়াল মাদ্রিদ কিংবদন্তি রাউল স্পেনের হয়ে তিনটি বিশ্বকাপ ও দুইটি ইউরো কাপে আংশগ্রহণ করেণ। ৩২৩ গোল করে ক্রিষ্টিয়ানো রোনালদোর আগে ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের সর্বোচ্চ গোলদাতা। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে জেতেন ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্সলীগ, লা লীগা, কোপা দেল রে সহ অসংখ্য শিরোপা। 


রাউল ২০১২ সালে এক মৌসুমের চু্ক্তিতে কাতারি ক্লাব আল সাদে যোগ দেন। আল সাদকে তিনি কাতার লীগ চ্যাম্পিয়ন ও এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জেতান।


রাউল তার ক্যারিয়ারের ১০০০তম ম্যাচ খেলেন আল সাদের হয়ে। আল সাদ তাকে এতটাই মুগ্ধ করেছিলো যে তিনি আরো এক মৌসুমে আল সাদের হয়ে খেলতে সম্মত হন। টানা দুই মৌসুম আল সাদের হয়ে খেলে রাউল চলে যান আমেরিকান মেজর লীগ সকারের ক্লাব নিউয়ার্ক কসমসে। সেখানেই রাউল ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে তার ক্যারিয়ারের ইতি টানেন। 


জুনিনহো (ব্রাজিল) আল গারাফা (২০০৯-১১)


ব্রাজিলিয়ান জুনিনহো  বিশ্বের অন্যতম সেরা ফ্রি-কিক টেকার। ফ্রেঞ্চ ক্লাব অলিম্পিক লিঁওর হয়ে ৭টি লীগ শিরোপা জয়ের পর জুনিনহো ফ্রাঞ্চ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগেই লিঁওকে এক আবেগঘন বিদায় দিয়ে ২০০৯ সালে কাতারি ক্লাব আল গারাফাতে পাড়ি জমান জুনিনহো।


আল গারাফার অধিনায়কত্বের বাহুবন্ধনী  হাতে বেঁধে প্রথম মৌসুমেই  ক্লাবের হয়ে ট্রেবল জেতেন জুনিনহো। আল গারাফার ট্রফি কেসে যোগ করেন কাতারি স্টার কাপ, কাতার ক্রাউন প্রিন্স কাপ ও কাতার স্টার লীগ শিরোপা।


২০১০ সালে তিনি হন কাতারের সেরা খেলোয়াড়। কাতার স্টার লীগে খেলা তিনি সেরা ব্রাজিলিয়ানদের একজন।



জাভি হার্নান্দেজ (স্পেন) আল সাদ (২০১৫-২০১৯) 


বার্সেলোনা কিংবদন্তি জাভি হার্নান্দেজ খেলোয়াড় হিসেবে কাতারে সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন। তিনি কাতারে আসেন খেলোয়াড় হিসেবে এখন আছেন কোচ হিসেবে। 


জাভি স্পেনের হয়ে একবার বিশ্বকাপ, দুইবার ইউরো কাপ; বার্সেলোনার হয়ে  উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্সলীগ, লা লীগা, কোপা দেল রে, উয়েফা সুপার কাপ, ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ জেতেন। 


বার্সার জার্সি গায়ে রেকর্ড দ্বিতীয় বারের মত ট্রেবল জয়ের পর ২০১৪-১৫ মৌসুম শেষ করেই মরুর দেশ কাতারে থিতু হন জাভি। ২০১৫-১৬ মৌসুমে কাতারের সবচেয়ে সফল ক্লাব আল সাদে যোগ দেন তিনি।


সাবেক স্প্যানিশ মিডফিল্ডার জাভি আল সাদের খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে জিতেছেন কাতার স্টার লীগ, কাতার ক্লাব ও  আমির অফ কাতার কাপ। যদিও তিনি এএফসি এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সেমিফাইনাল পাড় হতে পারেননি, আল সাদের খেলোয়াড় হিসেবেও না কোচ হিসেবেও না।



ওয়েন্সিলি স্নাইডার ( নেদারল্যান্ডস ) আল গারাফা (২০১৮-১৯) 


ওয়েন্সিলি স্নাইডার ছিলেন তার প্রজন্মের অন্যতম সেরা সৃজনশীল মিডফিল্ডার। কাতারি ক্লাব আল গারাফার হয়ে নিজের ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলেই বুট জোড়া আজীবনের জন্য তুলে রাখেন  উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জয়ী সাবেক এই ডাচ মিডফিল্ডার। 


ডাচ ক্লাব আয়াক্স আমাস্টারডামের হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন স্নাইডার। আয়াক্স হয়ে রিয়াল মাদ্রিদ তার পর ইন্টার মিলান । ইতালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলানের হয়ে ট্রেবল জয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন তিনি। 


ক্যারিয়ারের সয়াহ্নে কাতারে ফুটবল খেলতে আসেন স্নাইডার। ২০১৮ সালে আল গারাফে যোগ দেন তিনি, খেলেন মাত্র একটি মৌসুম। আল গারাফের হয়ে তার অর্জন ২২ ম্যাচে ১৫ গোল। আল গারাফের হয়ে শেষ ম্যাচ খেলে ২০১৯ সালে ফুটবল থেকে অবসর নেন ওয়েন্সিলি স্নাইডার ।



ফ্রাংক ডি বোর ( নেদারল্যান্ডস ) আল রায়ান (২০০৪-০৫)আল সামাল (২০০৫-০৬)


যেখানে গিয়েছেন একসাথে গিয়েছেন, যে ক্লাবে খেলেছেন এক সাথে খেলেছেন । কথাগুলো বলছিলাম দুই ডাচ ফুটবলার ফ্রা ডি বোর ও তার যমজ ভাই রোনাল্ড ডি বোর সম্পর্কে। আয়াক্ম আমাস্টারডাম, বার্সালোনা, রেন্জাস ও নেদারল্যান্ডের হয়ে  একসাথে খেলার পর দুই ভাই ২০০৪ সালে এক সাথে উড়াল দেন কাতারে। গন্তব্য ছিল কাতারি ক্লাব আল রায়ান।


ডি বোর ব্রাদার্স আল রায়ানের হয়ে কাতার এসসি কে ৩-২ গোলে পরাজিত করে দি আমির অফ কাতার কাপ জয় করেন। পরের মৌসুমেই তারা ক্লাব বদলে আল সমালে যোগ দেন।


আল সামালে অবশ্য ফ্রাংক বেশি দিন টিকতে পারেন নি। মাত্র একমাস আল সামালের হয়ে খেলে কাতারকে বিদায় বলেন ফ্রাংক ।কিন্তু রোনাল্ড ডি বোর আল সামালের হয়ে ৫০টি ম্যাচ খেলে ২০০৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন।


মার্শেল ডিজলি  (ফ্রাঞ্চ) আল গারাফা ( ২০০৪-০৫) কাতার এসসি (২০০৫-০৬)


২০০৩-০৪ মৌসুমে ইংলিশ ক্লাব চেলসিকে বিদায় বলার পর ১৯৯৮ বিশ্বকাপ জয়ী ফ্রেঞ্চ ফুটবলার মার্শেল ডিজলি কাতারি ক্লাব আল গারাফে যোগ দেন। সাথে নিয়ে আসেন আরেক ফ্রেঞ্চ ফুটবলার ফ্রাংক লুবেফকে। লুবেফ যোগ দেন আল সাদে।


আল গারাফের কোচ ছিলেন আরেক ফ্রেঞ্চ ব্রুনো মেটসু। অধিনায়ক ছিলেন লি রক। তাদের সমন্বয়ে ২০০৪ সালে লীগ শিরোপা ঘরে তুলে আল গারাফ। কিন্তু পরের মৌসুমে দল বদলে  কাতার এসসিতে যোগ দেন ডিজলি। ক্যারিয়ারের শেষ মৌসুমটি কাতার এসসিতে কাটিয়ে ফুটবলকে বিদায় দেন মার্শেল ডিজলি  ।



ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রোমারিও, মরোক্কান তারকা ফুটবলার মেদহি বেনাটিয়া, স্প্যানিশ তারকা সান্তি কাজরোলা, গাবি, হাবি মার্তিনেজের মতো হাই প্রোফাইল ফুটবলাররা নাম লিখিয়েছেন কাতারি ফুটবলে। কাতার স্টর লীগ এখন চীনের ফুটবলকে টেক্কা দিয়ে এশিয়ার সেরা লীগ হওয়ার দ্বার প্রান্তে। ফ্রেঞ্চ ক্লাব প্যারিস সঁ জার্মেইর এর মালিক নাসের আল খেলাফিও একজন কাতারি। এশিয়া ও ইউরোপে কাতার দিনকে দিন নিজেকে নতুন করে  চিনাচ্ছে। ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হয়ে কাতার আরো এসেছে পাদ-প্রদীপের আলোয়। ইউরোপের অনেক তারকা ফুটবলারই এখন কাতারে ফুটবল খেলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন।

No comments

Auto Scroll Stop Scroll