দাদীকে দেওয়া কথা রাখলেন বিশ্বকাপ জয়ী লুকাস পোডোলোস্কি

 দাদীকে দেওয়া কথা রাখলেন বিশ্বকাপ জয়ী লুকাস পোডোলোস্কি 




শেকরকে ভুলে যাননি লুকাস পোডোলোস্কি। ভুলে যাননি নিজের জন্মভূমি ও আত্মীয়দেরকেও। নিজের ফুটবল ক্যারিয়ারের সয়াহ্নে এসে হলেও যোগ দিলেন শৈশবের ক্লাব গোর্নিক জার্বেজে।


লুকাস পোডোলোস্কির জন্ম পোল্যান্ডের ছোট্ট শহর গ্লিচে। মাত্র দুই বছর বয়সে পিতামাতার সাথে জার্মানিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন পোল্ডি। জার্মানির সোনালী মাটিতে সোনা ফলিয়েছেন তিনি।ফুটবল নিয়ে তার বাম পায়ের শক্তি দেখেছে জার্মান ফুটবল সমর্থকেরা, বঞ্চিত হয়নি বিশ্ব ফুটবলপ্রেমীরাও। 



ফুটবল ক্লাব কোলনের হয়ে শুরু হয়েছিল তার ফুটবল যাত্রা। জার্মানির ছোট ক্লাবে ভালো খেলা মানেই জার্মান সেরা ক্লাব বায়ার্ণ মিউনিখে খেলার সুযোগ পাওয়া। এটা যেন বুন্দেসলীগার এক অলিখিত নিয়ম। তরুন পোডোলোস্কি বড় ফুটবলার হওয়ার আশার উড়ে গেলেন মিউনিখে। 


মিউনিখে থিতু হতে পারেননি পোল্ডি। আসল কথা হচ্ছে ক্লাব ফুটবলে কোন ক্লাবেই বেশি দিন স্থায়ী হয়নি তার ক্যারিয়ার। জার্মানি, ইংল্যান্ড, ইতালি, তুরস্ক, জাপানের বিভিন্ন ক্লাবে খেলার পর অবশেষে খুঁজে পেয়েছেন তার আসল নীড়। 


প্রায় প্রতিটা ফুটবলারের ক্ষেত্রে একটা বিশেষ বদনাম রয়েছে। তারা ক্লাবের হয়ে যতটা সাফল্য দেখাতে পারেন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে ততটা সফল হন না। কিন্তু পোডোলোস্কির ক্ষেত্রে কথাটি একদম ভিন্ন। পোডোলোস্কি যেন জন্মই নিয়েছেলেন জার্মানির সাদা জার্সিটাকে আরও সম্মানিত করার জন্য।



পোডোলোস্কির কিন্তু  ইচ্ছা ছিল জন্মভূমি পোল্যান্ডের হয়ে খেলা। সেই প্রতিক্ষায় বসেও ছিলেন । কবে ডাক আসে পোল্যান্ড থেকে। ক্লাবের হয়ে তার সাফল্যে পোলিশ সংবাদপত্রগুলো তাকে পোল্যান্ড জাতীয় দলে নেওয়ার কথা  জোড়ে সোরে লিখতে থাকে। কিন্তু পোলিশ জাতীয় দলের তৎকালীন কোচ পায়েল জানাসের মন তাতে গলে নি।


পায়েল জানাস সাফ জানিয়ে দেন- 



”পোডোলোস্কির চেয়ে ঢের ভালো ভালো স্ট্রাইকার পোল্যান্ডে রয়েছে। বুন্দেসলীগায় মাত্র এক দুই ম্যাচে সুযোগ পাওয়া ফুটবলারকে আমরা জাতীয় দলে ডাকতে পারি না।”



তার কথার মন ভেঙে যায় পোডোলোস্কির। জার্মানির হয়ে খেলের জন্যই সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এদিকে জার্মান মিডিয়াও তাকে নিয়ে লিখতে থাকে। বল নিয়ে তার গতি ও বাম পায়েরে জোড়ালো শট দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন পোল্ডি। কিন্তু মৌসুম শেষে তার দল এফসি কোলন বুন্দেসলিগা থেকে অবনমন হয়ে  দ্বিতীয় লিগ বুন্দেসটিগায় চলে যায়।


কোলনের অবনম হলেও জহুরি চিনতে ভুল করেননি তৎকালীন জার্মান কোচ রুডি ভোলার। ২০০৪ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে জার্মানির জার্সি গায়ে অভিষেক হয় লুকাস পোডোলোস্কির। হাঙ্গেরীর বিপক্ষে বদলি হিসেবে নেমে ১৯৭৫ সালের পর দ্বিতীয় লিগ থেকে খেলা কোন খেলোয়াড় হিসেবে জাতীয় দলে খেলার নজির গড়েন তিনি।



তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। জার্মানি জাতীয় দলের হয়ে যেই কোচ হয়ে আসুন না কেন পোডোলোস্কি ছিলেন তার অটোমেটিক চয়েজ। ২০০৪ ইউরো জার্মান জাতীয় দলে পোডোলোস্কি ছিলেন সবচেয়ে ক্ষুদে খেলোয়াড়। ২০০৬ বিশ্বকাপের পর থেকে প্রায় প্রতিটি আসরে জার্মানির লেফট উইং সামলানোর দায়িত্ব পোল্ডির কাঁধেই পড়ে। পোল্ডিও তার গতি আর বাম পায়ের শক্তি দিয়ে জার্মানির গতিময় ফুটবলকে আরো বেশি গতি দিয়েছেন। প্রায় প্রতিটি আসরেই শিরোপার কাছে গিয়েও শিরোপা ধরা দিচ্ছিল না জার্মানদের হাতে।



২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপ। জার্মানির গায়ে আসরের সেরা দলের তাকমা লাগিয়ে দিচ্ছিল বিশ্বের প্রায় সব মিডিয়া ও ফুটবল বিশ্লেষকেরা। কিন্তু খেলা যে ব্রাজিলে। লাতিনের সেরা দুই দল ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাকে হটিয়ে কিভাবে বিশ্বকাপ ইউরোপে নিয়ে আসেন পোডোলোস্কিরা, সেটা দেখার অপেক্ষায় ছিল সমগ্র ফুটবল বিশ্ব। বিশ্বকে তাক লাগিয়ে আর লাতিনকে স্তব্ধ করে বিশ্বকাপ ইউরোপে নিয়ে আসে জার্মানরা। 



পোডোলোস্কি অবশ্য খুব বেশি খেলার সুযোগ পাননি । কিন্তু যে দলটি বিশ্বকাপ জেতে সেটি ছিল জার্মান কোচ জোয়াকিম লো’র দীর্ঘ দিনের পরিশ্রম আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফসল। লুকাস পোডোলোস্কি ছিলেন সেই দলের মোক্ষম অস্ত্র। 


২০১৬ ইউরোতে দলে থাকলেও খুব বেশি খেলার সুযোগ মিলছিলো না। জার্মানি জাতীয় দল যে ততদিনে কানায় কানায় তারকায় ঠাসা। এবার সময় এসেছে সাদা জার্সিকে বিদায় বলার। নতুনদের আরো বেশি সময় ও সুযোগ দেওয়ার জন্য ২০১৭ সালে জার্মানির হয়ে আর্ন্তজাতিক ফুটবলকে বিদায় বলেন লুকাস পোডোলোস্কি।




জার্মানির হয়ে অবসর নিলেও ক্লাব ফুটবল চালিয়ে যান তিনি। আর সেখানেই সবাইকে চমকে দিলেন । ৩৬ বছর বয়স্ক পোল্ডি যোগ দিলেন পোল্যান্ডের ক্লাব গোর্নিক জার্বেতে। বুন্দেসলীগা ও তুরস্কের অনেক বড় বড় ক্লাব তাকে চাচ্ছিল। কিন্তু তিনি যে ঋণ শোধ করতে মরিয়া। 


তার স্ত্রী মোনিকা পোলিশ। তারা দুজনে সবসময় পোলিশ ভাষায় কথা বলেন। তাদের সন্তানদের সাথেও তারা পোলিশ ভাষায় কথা বলেন। পোডোলোস্কির দাদি জোফিয়া, যার সাথে পোল্ডি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। বিশ্বকাপ জেতার পর গলায় মেডেল ঝুলিয়ে দাদির সাথে উদযাপনও করেছেন। তার দাদি চাইতেন, পোল্ডি যেন তার জন্মভূমির নিজ শহরের ক্লাবে হয়ে খেলেন। দাদিকে কথাও দিয়েছিলেন তিনি। যদিও দুই বছর আগে তার দাদি মারা গেছেন তবু দাদিকে দেওয়া কথা ভুলে যাননি পোডোলোস্কি। আর তাই টাকা আর খ্যাতির মোহ ত্যাগ করে ভালবেসে পোডোলোস্কি ফিরে গেলেন পোল্যান্ডে।

No comments

Auto Scroll Stop Scroll